১৫ আগষ্ট! অন্ধকারাচ্ছন্ন বাংলাদেশ
- আপলোড সময়: ০৬:২২:৫৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ অগাস্ট ২০২২
- / ৮৭৯ বার পড়া হয়েছে
আতিকুল ইসলাম জাকারিয়া’র কলামঃ- ১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্তের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক সাম্প্রদায়িক ও অসম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলেও স্বাধীন সত্তা নিয়ে বাঙালি জাতি সেদিন মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারেনি। বাঙালি জাতির উপর চেপে বসে পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের সীমাহীন বৈষম্যনীতি ও শোষন, নির্যাতন আর নিপীড়ন। তারা এদেশের মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদা তথা সকল ক্ষেত্রে চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বাগ্রে এই প্রকৃত সত্যটি গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
তাইতো তিনি স্বীয় সীমাহীন ত্যাগ, নিরন্তর সংগ্রাম, কারাবরণ, অপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতা, অনলবর্ষী বাগ্মিতা আর বিশাল মহানুভবতার মাধ্যমে বঙ্গীয় ব-দ্বীপের ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই জনপদের সর্বস্তরের মানুষের মনে-মননে ও মগজে স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ সঞ্চারিত করে তাদেরকে একই অটুট বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানী শাসন, শোষন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে রচিত হয়েছে জাতীয় মুক্তি অজর্নের একেকটা সোপান। তাইতো প্রেক্ষাপট তৈরি হয় ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৮’র আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ঐতিহাসিক ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুন্থান, ৭০’র নির্বাচন আর সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর বাঙ্গালি জাতির আন্দোলন- সংগ্রামের এই সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন অগ্রনায়ক। সুদীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদান ও ২ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা। অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। যার নির্মাতা হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সূচিত হলো নতুন এক অধ্যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। স্বজন হারানোর বেদনায় বিমর্ষ বাঙালি জাতি। চারদিকে ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্বল হারানো দিশেহারা মানুষের হাহাকার। এমনি এক কঠিন বাস্তবতায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের হাল ধরলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি দেশ গড়ার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বুক চিতিয়ে। ক্ষুধা, দারিদ্রমুক্ত ও শোষনমুক্ত একটি সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থার পূণর্গঠন,সংবিধান প্রণয়ন, এক কোটি মানুষের পূণর্বাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিধ্বস্ত কৃষি অবকাঠামো পূণর্গঠন, কৃষি বিপ্লব, শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, নারীদের কল্যাণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, বন্ধ শিল্প-কারখানা চালুকরণসহ অগণিত উন্নয়নধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃতের মাধ্যমে অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় সব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় ও জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে বাংলাদেশ। এভাবে একের পর এক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের মাধ্যমে ও সদ্য স্বাধীন দেশের যাবতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বঙ্গবন্ধু যখন বাংলাদেশকে কাংখিত উন্নতি ও অগ্রগতির লক্ষ্যপানে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন-ঠিক তখনই এল বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসের কলংকিত সেই ভয়াল কালো রাত। ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ সাল। এদিন সুবেহ্ সাদিক এর সময় স্বাধীনতার সূতিকাগার বলে পরিচিত বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটিতে মানব সভ্যতার ইতিহাসে নৃশংসতম হত্যাকান্ড সংঘটিত হলো। বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ-রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করে স্বাধীনতার চেতনাকে সমূলে ধ্বংস করার নীল নকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত অপশক্তি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের যোগসাজসে সেনাবাহিনীর বিপথগামী উচ্চাভিলাসী নরপিশাচের দল হত্যা করে স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর সহধর্মিনী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তাঁর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, জৈষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, মেজো পুত্র শেখ জামাল, শিশুপুত্র রাসেল, পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তাঁর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্তা স্ত্রী বেগম আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ শিশুপুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আব্দুল নইম খান রিন্টু ও বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্ণেল জামিল উদ্দিন আহম্মেদ প্রমুখ। শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা দেশের বাইরে থাকায় সেদিন তাঁরা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।
১৫ আগষ্টের সেই ভয়াল কালো রাত আর শ্রাবন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল- বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর আকাশের মর্মছেঁড়া অশ্রুর প্লাবনে ঠিক যেন প্রকৃতিরই অশ্রুপাত। সিক্ত বাতাস কেঁদেছে সমগ্র বাংলায়। ঘাতকের উদ্যত অস্ত্রের আঘাতে শোকস্তব্ধ ও হতবিহবল পুরো বাঙালি জাতি। দিকভ্রান্ত গোটা বাংলাদেশ। ক্ষমতালোভী ষড়যন্ত্রেকারীরা বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করার মধ্য দিয়ে মূলত স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিকে এবং ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল অর্জনকে, আওয়ামী লীগকে সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে শুরু হয় অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের জঘন্যতম খেলা। খুনী মোশতাক নিজেকে অবৈধভাবে প্রেসিডেন্ট ঘোষনা করে ২০ আগষ্ট মার্শাল ল’জারি ও ২৫ আগষ্ট জিয়াউর রহমানকে চীফ অব আর্মি স্টাফ নিয্ক্তু করা হয়। মূলতঃ ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকগোষ্ঠীর শিখন্ডি হিসেবে ব্যবহৃত হয় খুনী মোশতাক। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহম্মেদ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের পথ চিরতরে বন্ধ করার অপপ্রয়াসে কুখ্যাত ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ-৫০/১৯৭৫ জারি করে। ৩ নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। জেনারেল জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষনা দেয়। সে সময় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন প্রধান বিচারপতি সায়েম।
জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল অস্ত্রের মুখে বিচারপতি সায়েমকে অপসারণ করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষনা করে। এভাবে প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধঙ্গুলি দেখিয়ে দেশে সামরিক অভ্যুন্থান, পাল্টা অভ্যুন্থান, হত্যা এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়। একের পর এক সামরিক স্বৈরশাসনের পালাবদল ঘটতে থাকে। জিয়াউর রহমান সামরিক কায়দায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের পথ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে ইনডেমনিটি (দায় মুক্তি) অধ্যাদেশটি বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে এক কলংকজনক অধ্যায়ের সূচনা করে। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের শুধু রক্ষাই করেনি বরং তাদেরকে বিভিন্ন দূতাবাসে কুটনৈতিক পদে নিরাপদ চাকুরী দিয়ে পুরষ্কৃত করে। যার ফলে বঙ্গবন্ধুর খুনীরা সদম্ভে খুনের কথা স্বীকার করে বিশে^র বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্বাক্ষাতকার দেওয়ার সাহস দেখিয়েছে। বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার গৃহিত সকল পদক্ষেপ সমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশ চলতে থাকে উল্টো পথে সেই পাকিস্তানি ভাবধারায়। ষড়যন্ত্রকারীদের বিষাক্ত নখরের আঁচরে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। শহীদ পরিবারের জন্য বঙ্গবন্ধু যে সকল বাড়ি বরাদ্দ করেছিলেন জিয়াউর রহমান জোরপূর্বক ওইসব বাড়ি থেকে শহীদ পরিবারের সদস্যদের উৎখাত করে। রাজাকার শিরোমনি শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী ও রাজাকার আলীমকে মন্ত্রী বানিয়ে দেয়। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে ১৯৭৮ সালে ফিরিয়ে আনে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী জামাত-শিবিরকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে। ফলশ্রæতিতে দেশে উগ্র সাম্পদায়িক মৌলবাদী জংগী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর মহান মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি ধর্ম নিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতিয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে ভুলুন্ঠিত করা হয়। জেল-জুলুম-হুলিয়ার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে বিলীন করে দেওয়ার অপপ্রয়াস পরিচালিত হয়। পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃত করা হয় অত্যন্ত নগ্নভাবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস তথা মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির পিতার নেতৃত্বের ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানতে দেওয়া হয়নি। মাত্র সাড়ে ৩ বছরের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু যে সুদুরপ্রসারী উন্নয়নের বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন তা এক নিমিষেই স্থবির হয়ে পরে। দেশ নিমজ্জিত হয় অন্ধকারের অতল গহবরে। দূর্ভাগ্য আমাদের। দূর্ভাগ্য এই হতভাগা বাঙালি জাতির। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট পিতা হারা বাঙালি জাতিকে ঢেকে দিল অশুভ মেঘের কালো ছায়া। সেই কালোরাতের আঁধারে সব আলোর পরশ যেন ডুবে গেল ঘোর অমানিশায়।
লেখকঃ-
আতিকুল ইসলাম জাকারিয়া
সাধারণ সম্পাদক
ভালুকা উপজেলা কৃষক লীগ, ময়মনসিংহ।