সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ১০:২৪ পূর্বাহ্ন

ময়মনসিংহের সদরসহ ৯টি উপজেলায় কর্মসৃজন প্রকল্পে শুভঙ্করের ফাঁকি

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১৭ আগস্ট, ২০২১, ১১.৪৮ এএম
  • ১৯০ বার পাঠিত

খোকন আহম্মেদ,ময়মনসিংহ প্রতিনিধি: ময়মনসিংহে সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০২০-২১ অর্থ বছরের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (কর্মসৃজন প্রকল্পে) শ্রমিকের বদলে ভেকু মেশিনের মাধ্যমে কাজ করে শ্রমিকের হাজিরা দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের মাধ্যমে শুভঙ্করের ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। তবে ভেকু মেশিনে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়গুলো তদন্ত করা হচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন কর্মসৃজন প্রকল্পের তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত ময়মনসিংহ জেলা ত্রাণ ও পূর্নবাসন কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেন জানান।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কর্মসৃজন কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কোথাও ভেকু মেশিনে নামমাত্র কাজ করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৪০ ভাগ কাজ বাস্তবায়ন হয় নাই। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নেওয়া এই প্রকল্পে কর্তৃপক্ষের নিরবতার সুযোগে লাগামহীন দুর্নীতি প্রতিটি অর্থ বছরেই জাঁকজমকভাবেই চলছে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে অনিয়মের সাথে প্রকল্প সংশ্রিষ্টরা সম্পৃক্ত রয়েছেন। যদিও এই কর্মসূচিতে কোনো দুর্নীতি হচ্ছে না বলে দাবি প্রকল্প সংশ্রিষ্টদের। তবে বাস্তবে ৪০দিনের কর্মসূচি প্রকল্পে ঘটছে শুভঙ্করের ফাঁকি। শ্রমিকদের কাজ কেড়ে নিয়ে ভেকু মেশিন দিয়ে কাজ করে সরকারের শ্রমিক বান্ধবনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে দুর্নীতিবাজ সংশ্রিষ্টরা। এনিয়ে ভুক্তভোগী বঞ্চিত শ্রমিক পর্যায়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলেও তা অভিযোগ করার সাহস নেই প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের। কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো নিয়মনীতি মানছেন না প্রকল্প সংশ্রিষ্টরা।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা যায়, কর্মসৃজন প্রকল্পে কাগজ-কলমে কাজ হলেও মাঠ পর্যায়ে দেখা গেছে বিপরীত চিত্র। প্রতিদিন ২০০টাকা মুজুরি হিসাবে কাগজে-পত্রে শ্রমিকের নাম থাকলেও বাস্তবে শ্রমিকের বিপরীতে ভেকু দিয়ে প্রকল্পের কাজ করা হয়। আবার কোথাও নাম মাত্র মাটি ফেলে কর্মসৃজন প্রকল্প শতভাগ বাস্তবায়ন দেখানো হচ্ছে। ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রকল্প সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে এমন সত্যতা পাওয়া যায়।
সূত্রমতে, ত্রাণ ও পুনবাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০-২১ অর্থবছরে ময়মনসিংহ জেলার ১৩টি উপজেলার আওতায় কর্মসৃজন কর্মসূচির (ইজিপিপি) প্রকল্পের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ২ হাজার ২টি প্রকল্পের অনুকূলে উপকারভোগীর সংখ্যা ১লাখ ১৮ হাজার ৭শত ৪১ জন শ্রমিকের বিপরীতে মোট অর্থ বরাদ্ধের পরিমাণ ওয়েজ-ননওয়েজ ও সরদার মিলিয়ে প্রায় ১ শত কোটি টাকা। অর্ধশত কোটি টাকা বরাদ্ধে জেলার এ প্রকল্পে শ্রমিকরা উপকারভোগী হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে হচ্ছে তার উল্টো। জেলার গৌরিপুর, নান্দাইল, তারাকান্দা, হালুয়াঘাট, ত্রিশাল, গফুরগা, ধোবাউড়া, ভালুকা,ফুলপুর উপজেলাগুলোতে অনেকাংশে অতিদরিদ্রদের কর্মসৃজন প্রকল্পে শ্রমিকের বদলে কাজ হয়েছে ভেকু মেশিনে । ফলে প্রকল্পের টাকা হরিলুটের জন্য ভুয়া প্রকল্প ও মাষ্টাররোল তৈরি করে শ্রমিক দিয়ে টাকা উত্তোলন করে তা ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়। প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে মোটা অংকের টাকা চলে যায় পিআইও’র পকেটে।
ধোবাউড়া উপজেলায় ভূয়া প্রকল্পের মাধ্যমে কোটি কোটি সরকারী টাকা আত্মসাতের বিরুদ্ধে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়তোষ বিশ্বাস বাবুল ৬ জুলাই লিখিত অভিযোগের দায়ের করেন। লিখিত অভিযোগ সুত্রে জানা গেছে, পোড়াকান্দুলিয়া ইউনিয়নে হতদরিদ্রদের জন্যে প্রথম পর্যায়ের শ্রমিকবিহীন ৭টি ভূয়া প্রকল্পে তেত্রিশ লক্ষ টাকা লুপপাট করা হেেয়ছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে একই সমপরিমান টাকা বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
ধোবাউড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহম্মেদ অভিযোগ দায়েরের সত্যতা স্বীকার করে বলেন , আওয়ামী লীগ নেতা প্রিয়তোষ বিশ্বাস বাবুলের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত করে ৮টি প্রকল্পে ভেকু মেশিনের ব্যবহারের সত্যতা প্রমান হওয়ায় ওই প্রকল্পের বিল ফেরৎ পাঠানো হয়েছে।
ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাশেদুজ্জামান প্রকল্পের অভিাযোগ প্রাপ্তির কথা স্বীকার করে বলেন, এই বিষয়ে প্রকল্প কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ভেকু মেশিনে কাজ করার সময় অপনাদের তদারকির দুর্বলতা ছিলো কি ও ৮টি প্রকল্পে শ্রমিকরা মজুরী বঞ্চিত হলেন কি? এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেননি।

এছাড়া নান্দাইল উপেেজলায় প্রকল্পের বরাদ্দের ৪৫% টাকা প্রকল্প বাস্তবায় কর্মকর্তা ও সিন্ডিকেটকে না দিলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হয় না। কমিশন দিতে অপারগতা জানালে চন্ডিপাশা ইউনিয়নে কর্মসৃজন প্রকল্পের কোন কাজ করতে পারেন নাই। কমিশন সমঝোতা না হওয়ায় ইউনিয়নবাসী প্রতি অর্থ বছরে সরকারি বিভিন্ন সুবিধা (কর্মসৃজন, ভিজিএফ, জিআর সহ ইত্যাদি) থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, উপজেলায় দুর্নীতিবাজ প্রকল্প কর্মকর্তার নির্দেশে এক্সাবেটর ব্যবহার করে নামমাত্র শ্রমিক দিয়ে কৌশলে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করেছে।
নান্দাইল উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক চৌধুরী স্বপন বলেন, কর্মসৃজন প্রকল্পের সমুদয় হরিলুট। যে কয়েকটি কাজ হয়েছে তা এক্সাবেটর দিয়ে। এতে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ থেকে কর্মসংস্থান থেকে হতদরিদ্ররা বঞ্চিত হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, কয়েকটি ইউনিয়নে মেশিন দিয়ে কাজ দেখানো হলেও বাকী ইউনিয়নগুলোতে কাজ না করেই প্রকল্প সংশ্রিষ্টরা ৯০ভাগ কাজ বাস্তবায়নের বিল প্রস্তুুত করে টাকা ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছে।

নান্দাইল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আব্দুল আলীম এর নিকট অনিয়ম দুর্নীতির বাস্তবতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজ তো শেষ এখন এ বিষয়ে কিসের নিউজ।

তারাকান্দা উপজেলায় প্রথম পর্যায়ে ১০টি ইউপিতে ৫৮টি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪৮টিসহ মোট ১০৫টি প্রকল্পে প্রায় ৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ”ছেপ দিয়ে ল্যাপ” দেওয়ার মতো করে টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এ কাজে সংশ্লিষ্টদের প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা জাকারিয়া। তিনি নামমাত্র কয়েকটি ইউনিয়নে কাজ দেখিয়ে শ্রমিকদের ভুয়া মাষ্টাররোলের মাধ্যমে বিল অনুমোদন টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করেন।
উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা জাকারিয়া বলেন, অন্যান্য প্রকল্পে এসব হতে পারে কর্মসৃজনে সঠিক ভাবেই শ্রমিক দিয়ে কাজ করা হয়েছে। তবে স্থানীয়রা জানায়, সরেজমিনে শ্রমিক তালিকা তদন্ত করলেই কাজে অনিয়ম-দূর্নীতির সত্যতার প্রমান মিলবে।
একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে গৌরীপুর উপজেলায়। এখানেও ১০টি ইউনিয়নে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ৪ হাজার ৪জন শ্রমিকের বিপরীতে মোট ৫২টি প্রকল্পে ভুয়া শ্রমিক মাষ্টাররোলে ৩কোটি ২০ লাখ ৩২ হাজার টাকা উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার যোগসাজসে টাকা ভাগ-বাটোয়রা করার অভিযোগ উঠেছে। তবে এ উপজেলায় এখনো দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের তালিকা জেলা তদারকি অফিস কতৃপক্ষের নিকট প্রেরন না করার অভিয়োগ রয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, গৈরিপুর উপজেলায় কর্মসৃজন প্রকল্পে গত কয়েক বছর ধরে শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হয় না। ভেকু মেশিনে নামমাত্র কাজ করে টাকা লুটপাট করেন সংশ্লিষ্টরা। সরেজমিনে শ্রমিক তালিকা অনুসন্ধান করলেই সত্যতা মিলবে।
গৈরিপুরের প্রকল্প কর্মকর্তা সোহেলে রানার সাথে মুঠো ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এসব বিষয়ে প্রকল্পের তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত ময়মনসিংহ জেলা ত্রাণ ও পূর্নবাসন কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেন জানান, অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে। শুনেছি কোন কোন উপজেলা এবং ইউনিয়নে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।

দয়াকরে নিউজটি শেয়ার করুন

আরো পড়ুন.....

greenaronno.com

themes052459
© All rights reserved © 2018 মুক্তকণ্ঠ
Theme Download From Bangla Webs