ময়মনসিংহ ১২:২২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সব কাজের ভাগই দিতে হয় শ্রীপুরের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে ঘুষের টাকায় কিনলেন কোটি টাকার জমি

দৈনিক মুক্তকণ্ঠ
  • আপলোড সময়: ১১:৪৫:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ জুলাই ২০২১
  • / ৬৯৪ বার পড়া হয়েছে

টি.আই সানি,নিজস্ব প্রতিনিধি গাজীপুরঃ বিদ্যালয়ের রুটিন মেরামত, ক্ষুদ্র মেরামত, প্রাক প্রাথমিক, প্লেয়িং এক্সোসরিস, স্লিপ বরাদ্ধের টাকার ভাগ দিতে হয় গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল হাসানকে। এছাড়াও বিদ্যলয় পরিদর্শনে গেলেও তাকে টাকার একটি অংক খামে ভরে খুঁশি করতে হয় শিক্ষকদের। শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতেও শিক্ষা কর্মকর্তার নির্দ্দিষ্ট করা দোকান থেকেই অধিক দামে কিনতে হয়। অন্যথায় শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানী ও হুমকী দেয়ার অভিযোগ উঠেছে এই শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। যদিও প্রশাসনিক জটিলতা এড়াতে শিক্ষকদের অধিকাংশই মুখ খুলতে রাজি হচ্ছেন না। নিরবে নিভৃতে শিক্ষা কর্মকর্তাকে খুশি করতে সরকারী বরাদ্ধের একটি অংশ তার হাতে তুলে দিচ্ছেন। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, শ্রীপুরে নবজাতীয়করণ কৃত বিদ্যালয় নিয়ে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৬৬। প্রতি অর্থবছর রুটিন মেরামত, ক্ষুদ্র মেরামত, প্রাক প্রাথমিক, প্লেয়িং এক্সোসরিস খাতে উল্লেখিত বিদ্যালয়গুলোতে সরকারী বরাদ্ধের বিভিন্ন খাতের অর্থ আসে। প্রতি অর্থবছর এর অংক ছাড়িয়ে যায় কোটি টাকার উপর।বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানান যায়, গুটিকয়েক বিদ্যালয়ে সরকারী বরাদ্ধের কাজ হলেও অধিকাংশই উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই লুটপাট চলে। নজরদারীর অভাবে অধিকাংশ বরাদ্ধের টাকা চলে যায় শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের পকেটে। বিশেষ করে করোনার এই সময়ে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ব্যাপক লুটপাট হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরকারী বরাদ্ধে। চলতি অর্থবছরে উপজেলার ৫৭টি বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র মেরামতে ২লাখ টাকা করে মোট ১কোটি ১৪লাখ টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়। প্রতিটি বিদ্যালয় এই চেক গ্রহন করতে শিক্ষা কর্মকর্তাকে ১০হাজার টাকা করে দিতে হয়। অন্যথায় নানা ধরনের জটিলতার ভয় দেখানো হয় শিক্ষকদের। বিদ্যালয়গুলোতে প্রতি অর্থবছর শিক্ষার্থী অনুযায়ী ৭০হাজার থেকে ১লাখ টাকা করে স্লিপ বরাদ্ধের অর্থ দেয়া হয়। স্লিপের এ টাকা গ্রহন করতে শিক্ষা কর্মকর্তাকে ৫হাজার টাকা করে দিতে হয়। চলতি অর্থবছর করোনাকালীন এই সময়ে স্বাস্থ্য সামগ্রী কিনতে স্লিপ বরাদ্ধ হতে ৩৫হাজার টাকা করে বেধে দেয়া হয়। এই স্বাস্থ্য সামগ্রী কিনতে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সকল শিক্ষকদের নিয়ে সভা করে তার নির্দ্দিষ্ট করা দোকান থেকে এসব মালামাল ক্রয় করতে বলেন। শিক্ষা কর্মকর্তাকে খুশি করতে শিক্ষকরা মাওনা সার্জিকেল নামের একটি দোকান থেকে অধিক টাকা দিয়ে মালামাল সংগ্রহ করেন। এ কাজের সার্বিক দায়েত্বে ছিলেন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা নুরুন নাহার। তিনি বলেন, তাদের একটি সভায় এই দোকানের প্রতিনিধি উপস্থিত হয়ে আবদার করায় তিনি এই দোকান থেকে মালামাল কিনতে বলেছিলেন। তবে এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, তিনি এ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না, যখন জানতে পারেন তখন তিনি নুরুন নাহারকে শোকজ করেন।চলতি অর্থবছরে উপজেলার ৯টি বিদ্যালয়ে প্লেয়িং এক্সোসরিস কিনতে প্রতি বিদ্যালয়কে ১লাখ৫০হাজার টাকা করে মোট ১৩লাখ৫০হাজার টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়। কিন্তু নিজে লাভবান হতে শিক্ষা কর্মকর্তা বিদ্যালয়গুলোতে উক্ত সামগ্রী কিনতে নগদ টাকা না দিয়ে নিজে মাওনা চৌরাস্তার সুমন ষ্টিল হতে বিদ্যালয়গুলোতে মালামাল গুলো সরবরাহ করেন। এতে শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। এছাড়াও বিদ্যালয়ে কমিটি গঠন, শিক্ষকদের উচ্চতর স্কেল প্রাপ্তি, অডিটের কথা বলে ঘুষ আদায়, বেতন ভাতার জটিলতা সহ নানা কাজে তাকে টাকা দিতে হয়। কিছুদিন আগে বেতন ভাতার জন্য ইএফটিএন করতে প্রতি শিক্ষকদের কাছ হতে ৫’শত টাকা করে উপজেলায় কর্মরত ১হাজার শিক্ষকদের কাছ হতে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। ধনুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এসএমসির সদস্য তোফাজ্জল হোসেন বলেন, এমন অরাজকতা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। শিক্ষা কর্মকর্তা সবাইকে পুতুলে পরিনত করেছেন। তিনি যা বলছেন তা এখন সহ্য করতে হচ্ছে। সবই তিনি করছেন নিজে লাভবান হওয়ার জন্য। সরকার টাকা বরাদ্ধ দেয়ার পর আমরা খেলার সামগ্রী কিনতে চেয়েছিলাম, তিনি তা না করে এখন নিজেই ঠিকাদারের ভূমিকায় রয়েছেন। মাওনা ১নং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মোতাহার হোসেন খান বলেন, বিদ্যালয়ে সরকারী বরাদ্ধের টাকা আনতেও একটি অংশ শিক্ষা কর্মকর্তাকে দিতে হয়। এটা খুবই দুঃখজনক। এখানে কার টাকা কাকে দিব। টাকা না দেয়ায় তার বিদ্যালয়ের চেক এখনো প্রধান শিক্ষক আনতে পারেননি। অধিকাংশ চেকই তিনি আটকিয়ে রেখেছেন। শ্রীপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল হাসান বিগত ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৭সালে শ্রীপুরে যোগদান করেন। এর পূর্বে তিনি গাজীপুর সদর উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। উপজেলার প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নোট ও গাইড বই কিনতে বাধ্য করায় তার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে বিগত ২০১৮সালে রীট পিটিশন দায়ের করেন এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক। উচ্চ আদালত সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা সহ এই শিক্ষাকর্তার বিরুদ্ধে রুল জারী করলে ওই বছরই প্রশিক্ষনের নামে দেশ ত্যাগ করেন। এক বছর পর ২০১৯ সালে দেশে ফিরে ফের তিনি পূর্বের কর্মস্থলে যোগদান করেন। তার অনিয়ম দুর্নীতি গাজীপুরে এখন ওপেন সিক্রেট। কর্মরত স্টেশনেই ৩ কোটি টাকার সম্পদ প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুলের দীর্ঘদিন গাজীপুর জেলায় কর্মরত থেকে তিনি কয়েক কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। শ্রীপুরেই তার সম্পদের পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে তিন কোটি টাকার উপর। একজন সরকারী কর্মকর্তার এতো সম্পদ গড়ে তোলায় স্থানীয়রাও এখন বিস্মিত। শ্রীপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তার এ সম্পদের খোঁজ মিলেছে। অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য মতে, তিনি নিজ নামে শ্রীপুর পৌর এলাকার কেওয়া পশ্চিম খন্ড গ্রামে (দারগারচালা) শ্রীপুর উপজেলা সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে ১৫০৯১/১৬, ৮২৩৬/১৩, ১১৫৫৬/১৩, ৪১৩৩/১৫, ৮১৮৭/১৭, সহ আরো ভিন্ন ভিন্ন দলিলের মাধ্যমে প্রায় ৭০শতাংশ জমি কিনেছেন। উক্ত জমি শ্রীপুর উপজেলা ভূমি অফিসে নিজ নামে নামজারীও করেছেন। এর জোত নং যথাক্রমে ২২৪৩০, ১৯৩২২, ১৯১৩৯, ২৩৩৬৭, ২৩৫৫২। দলিলে থাকা তথ্য অনুযায়ী তার নাম কামরুল হাসান, পিতার নাম হাসান আলী, ঠিকানা উত্তর কাফরুল ঢাকা। সড়ক সংলগ্ন স্থানে কয়েকটি প্লটে কেওয়া মৌজায় তিনি স্থানীয় মহর আলী ও মাকাদুল ইসলামের কাছ থেকে ৩২শতাংশ, জালাল উদ্দিন গংদের কাছ থেকে ১২ শতাংশ, শাহজাহান গংদের কাছ থেকে ১৭.৫০ শতাংশ, জয়নাল গংদের কাছ থেকে ১৭.৫০ শতাংশ জমি কিনেছেন। এছাড়াও উপজেলার বারতোপা এলাকায়ও বেশ কিছু জমি রয়েছে তার। ক্রয় করা এসব জমিতে সীমানাপ্রাচীর নির্মান করে ফটক লাগিয়ে রেখেছেন। সম্প্রতি তার এসব জমির বিষয়ে খোঁজ হওয়ায় অর্ধকোটি টাকায় একটি প্লট বিক্রি করেছেন, বাকীগুলোও বিক্রি করার প্রস্ততি নিয়েছেন। স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, শ্রীপুর পৌর শহরে কেওয়া পশ্চিম খন্ড গ্রামে শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল হাসানের এসব জমির প্রতি শতাংশের মূল্য প্রায় ৫-৭ লাখ টাকা। সে হিসেবে শ্রীপুরে কেওয়া মৌজায় থাকা তার জমির মূল্য হবে তিন কোটি টাকার উপর। একজন সরকারী কর্মকর্তার কর্মরত স্টেশনে এতো সম্পদের উৎস্য নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে আলোচনা চলছে সর্বত্রই।স্থানীয় শ্রমিকলীগ নেতা জালাল উদ্দিন বলেন, একজন সরকারী কর্মকর্তা যেভাবে তাদের এলাকায় জমি কিনছেন তাতে অচিরেই গ্রামের অধিকাংশ জমি তার হয়ে যাবে। সড়কের পাশে প্লট করে এসব জমি সাজিয়ে রেখেছেন। এখনো তার জমি কেনা অব্যাহত রয়েছে। হঠাৎ করে একজন শিক্ষা কর্মকর্তা কেমন করে এতো সম্পদের মালিক হয়েছেন তা ভেবে পাচ্ছি না। স্থানীয় মহর আলী বলেন, তিনি প্রতি শতাংশ ৩লাখ টাকা করে শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল হাসান তার কাছ থেকে ৩২শতাংশ জমি কিনেছেন। বর্তমানে এই প্লটটির দাম কোটি টাকার উপরে হবে। নিজের বিরুদ্ধে উঠা বিভিন্ন অভিযোগ অস্বীকার করে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, বিভিন্ন প্রাথমিক শিক্ষকরা নানাভাবে তার বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্ধ চান। কিন্তু আমরা ধারাবাহিকতা বজায়ের স্বার্থে তা দিতে না পারায় হয়তো অনেকে ক্ষিপ্ত হয়ে এমন অভিযোগ করছেন। এসবের কোন সত্যতা নেই। কর্মরত স্টেশনে জমি কেনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি ২০০৮ সালে এবং তারও বেশ কয়েকবছর পূর্বে এসব জমি কিনেছিলাম। যদিও এখন তা বিক্রি করে দিচ্ছি। জমি কেনার অর্থের বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোফাজ্জল হোসেন বলেন, তার কাছে এখনো এমন কোন অভিযোগ আসেনি। তবে খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান তিনি ।

ট্যাগস :

Please Share This Post in Your Social Media

About Author Information

সব কাজের ভাগই দিতে হয় শ্রীপুরের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে ঘুষের টাকায় কিনলেন কোটি টাকার জমি

আপলোড সময়: ১১:৪৫:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ জুলাই ২০২১

টি.আই সানি,নিজস্ব প্রতিনিধি গাজীপুরঃ বিদ্যালয়ের রুটিন মেরামত, ক্ষুদ্র মেরামত, প্রাক প্রাথমিক, প্লেয়িং এক্সোসরিস, স্লিপ বরাদ্ধের টাকার ভাগ দিতে হয় গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল হাসানকে। এছাড়াও বিদ্যলয় পরিদর্শনে গেলেও তাকে টাকার একটি অংক খামে ভরে খুঁশি করতে হয় শিক্ষকদের। শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতেও শিক্ষা কর্মকর্তার নির্দ্দিষ্ট করা দোকান থেকেই অধিক দামে কিনতে হয়। অন্যথায় শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানী ও হুমকী দেয়ার অভিযোগ উঠেছে এই শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। যদিও প্রশাসনিক জটিলতা এড়াতে শিক্ষকদের অধিকাংশই মুখ খুলতে রাজি হচ্ছেন না। নিরবে নিভৃতে শিক্ষা কর্মকর্তাকে খুশি করতে সরকারী বরাদ্ধের একটি অংশ তার হাতে তুলে দিচ্ছেন। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, শ্রীপুরে নবজাতীয়করণ কৃত বিদ্যালয় নিয়ে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৬৬। প্রতি অর্থবছর রুটিন মেরামত, ক্ষুদ্র মেরামত, প্রাক প্রাথমিক, প্লেয়িং এক্সোসরিস খাতে উল্লেখিত বিদ্যালয়গুলোতে সরকারী বরাদ্ধের বিভিন্ন খাতের অর্থ আসে। প্রতি অর্থবছর এর অংক ছাড়িয়ে যায় কোটি টাকার উপর।বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানান যায়, গুটিকয়েক বিদ্যালয়ে সরকারী বরাদ্ধের কাজ হলেও অধিকাংশই উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই লুটপাট চলে। নজরদারীর অভাবে অধিকাংশ বরাদ্ধের টাকা চলে যায় শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের পকেটে। বিশেষ করে করোনার এই সময়ে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ব্যাপক লুটপাট হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরকারী বরাদ্ধে। চলতি অর্থবছরে উপজেলার ৫৭টি বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র মেরামতে ২লাখ টাকা করে মোট ১কোটি ১৪লাখ টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়। প্রতিটি বিদ্যালয় এই চেক গ্রহন করতে শিক্ষা কর্মকর্তাকে ১০হাজার টাকা করে দিতে হয়। অন্যথায় নানা ধরনের জটিলতার ভয় দেখানো হয় শিক্ষকদের। বিদ্যালয়গুলোতে প্রতি অর্থবছর শিক্ষার্থী অনুযায়ী ৭০হাজার থেকে ১লাখ টাকা করে স্লিপ বরাদ্ধের অর্থ দেয়া হয়। স্লিপের এ টাকা গ্রহন করতে শিক্ষা কর্মকর্তাকে ৫হাজার টাকা করে দিতে হয়। চলতি অর্থবছর করোনাকালীন এই সময়ে স্বাস্থ্য সামগ্রী কিনতে স্লিপ বরাদ্ধ হতে ৩৫হাজার টাকা করে বেধে দেয়া হয়। এই স্বাস্থ্য সামগ্রী কিনতে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সকল শিক্ষকদের নিয়ে সভা করে তার নির্দ্দিষ্ট করা দোকান থেকে এসব মালামাল ক্রয় করতে বলেন। শিক্ষা কর্মকর্তাকে খুশি করতে শিক্ষকরা মাওনা সার্জিকেল নামের একটি দোকান থেকে অধিক টাকা দিয়ে মালামাল সংগ্রহ করেন। এ কাজের সার্বিক দায়েত্বে ছিলেন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা নুরুন নাহার। তিনি বলেন, তাদের একটি সভায় এই দোকানের প্রতিনিধি উপস্থিত হয়ে আবদার করায় তিনি এই দোকান থেকে মালামাল কিনতে বলেছিলেন। তবে এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, তিনি এ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না, যখন জানতে পারেন তখন তিনি নুরুন নাহারকে শোকজ করেন।চলতি অর্থবছরে উপজেলার ৯টি বিদ্যালয়ে প্লেয়িং এক্সোসরিস কিনতে প্রতি বিদ্যালয়কে ১লাখ৫০হাজার টাকা করে মোট ১৩লাখ৫০হাজার টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়। কিন্তু নিজে লাভবান হতে শিক্ষা কর্মকর্তা বিদ্যালয়গুলোতে উক্ত সামগ্রী কিনতে নগদ টাকা না দিয়ে নিজে মাওনা চৌরাস্তার সুমন ষ্টিল হতে বিদ্যালয়গুলোতে মালামাল গুলো সরবরাহ করেন। এতে শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। এছাড়াও বিদ্যালয়ে কমিটি গঠন, শিক্ষকদের উচ্চতর স্কেল প্রাপ্তি, অডিটের কথা বলে ঘুষ আদায়, বেতন ভাতার জটিলতা সহ নানা কাজে তাকে টাকা দিতে হয়। কিছুদিন আগে বেতন ভাতার জন্য ইএফটিএন করতে প্রতি শিক্ষকদের কাছ হতে ৫’শত টাকা করে উপজেলায় কর্মরত ১হাজার শিক্ষকদের কাছ হতে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। ধনুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এসএমসির সদস্য তোফাজ্জল হোসেন বলেন, এমন অরাজকতা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। শিক্ষা কর্মকর্তা সবাইকে পুতুলে পরিনত করেছেন। তিনি যা বলছেন তা এখন সহ্য করতে হচ্ছে। সবই তিনি করছেন নিজে লাভবান হওয়ার জন্য। সরকার টাকা বরাদ্ধ দেয়ার পর আমরা খেলার সামগ্রী কিনতে চেয়েছিলাম, তিনি তা না করে এখন নিজেই ঠিকাদারের ভূমিকায় রয়েছেন। মাওনা ১নং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মোতাহার হোসেন খান বলেন, বিদ্যালয়ে সরকারী বরাদ্ধের টাকা আনতেও একটি অংশ শিক্ষা কর্মকর্তাকে দিতে হয়। এটা খুবই দুঃখজনক। এখানে কার টাকা কাকে দিব। টাকা না দেয়ায় তার বিদ্যালয়ের চেক এখনো প্রধান শিক্ষক আনতে পারেননি। অধিকাংশ চেকই তিনি আটকিয়ে রেখেছেন। শ্রীপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল হাসান বিগত ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৭সালে শ্রীপুরে যোগদান করেন। এর পূর্বে তিনি গাজীপুর সদর উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। উপজেলার প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নোট ও গাইড বই কিনতে বাধ্য করায় তার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে বিগত ২০১৮সালে রীট পিটিশন দায়ের করেন এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক। উচ্চ আদালত সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা সহ এই শিক্ষাকর্তার বিরুদ্ধে রুল জারী করলে ওই বছরই প্রশিক্ষনের নামে দেশ ত্যাগ করেন। এক বছর পর ২০১৯ সালে দেশে ফিরে ফের তিনি পূর্বের কর্মস্থলে যোগদান করেন। তার অনিয়ম দুর্নীতি গাজীপুরে এখন ওপেন সিক্রেট। কর্মরত স্টেশনেই ৩ কোটি টাকার সম্পদ প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুলের দীর্ঘদিন গাজীপুর জেলায় কর্মরত থেকে তিনি কয়েক কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। শ্রীপুরেই তার সম্পদের পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে তিন কোটি টাকার উপর। একজন সরকারী কর্মকর্তার এতো সম্পদ গড়ে তোলায় স্থানীয়রাও এখন বিস্মিত। শ্রীপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তার এ সম্পদের খোঁজ মিলেছে। অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য মতে, তিনি নিজ নামে শ্রীপুর পৌর এলাকার কেওয়া পশ্চিম খন্ড গ্রামে (দারগারচালা) শ্রীপুর উপজেলা সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে ১৫০৯১/১৬, ৮২৩৬/১৩, ১১৫৫৬/১৩, ৪১৩৩/১৫, ৮১৮৭/১৭, সহ আরো ভিন্ন ভিন্ন দলিলের মাধ্যমে প্রায় ৭০শতাংশ জমি কিনেছেন। উক্ত জমি শ্রীপুর উপজেলা ভূমি অফিসে নিজ নামে নামজারীও করেছেন। এর জোত নং যথাক্রমে ২২৪৩০, ১৯৩২২, ১৯১৩৯, ২৩৩৬৭, ২৩৫৫২। দলিলে থাকা তথ্য অনুযায়ী তার নাম কামরুল হাসান, পিতার নাম হাসান আলী, ঠিকানা উত্তর কাফরুল ঢাকা। সড়ক সংলগ্ন স্থানে কয়েকটি প্লটে কেওয়া মৌজায় তিনি স্থানীয় মহর আলী ও মাকাদুল ইসলামের কাছ থেকে ৩২শতাংশ, জালাল উদ্দিন গংদের কাছ থেকে ১২ শতাংশ, শাহজাহান গংদের কাছ থেকে ১৭.৫০ শতাংশ, জয়নাল গংদের কাছ থেকে ১৭.৫০ শতাংশ জমি কিনেছেন। এছাড়াও উপজেলার বারতোপা এলাকায়ও বেশ কিছু জমি রয়েছে তার। ক্রয় করা এসব জমিতে সীমানাপ্রাচীর নির্মান করে ফটক লাগিয়ে রেখেছেন। সম্প্রতি তার এসব জমির বিষয়ে খোঁজ হওয়ায় অর্ধকোটি টাকায় একটি প্লট বিক্রি করেছেন, বাকীগুলোও বিক্রি করার প্রস্ততি নিয়েছেন। স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, শ্রীপুর পৌর শহরে কেওয়া পশ্চিম খন্ড গ্রামে শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল হাসানের এসব জমির প্রতি শতাংশের মূল্য প্রায় ৫-৭ লাখ টাকা। সে হিসেবে শ্রীপুরে কেওয়া মৌজায় থাকা তার জমির মূল্য হবে তিন কোটি টাকার উপর। একজন সরকারী কর্মকর্তার কর্মরত স্টেশনে এতো সম্পদের উৎস্য নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে আলোচনা চলছে সর্বত্রই।স্থানীয় শ্রমিকলীগ নেতা জালাল উদ্দিন বলেন, একজন সরকারী কর্মকর্তা যেভাবে তাদের এলাকায় জমি কিনছেন তাতে অচিরেই গ্রামের অধিকাংশ জমি তার হয়ে যাবে। সড়কের পাশে প্লট করে এসব জমি সাজিয়ে রেখেছেন। এখনো তার জমি কেনা অব্যাহত রয়েছে। হঠাৎ করে একজন শিক্ষা কর্মকর্তা কেমন করে এতো সম্পদের মালিক হয়েছেন তা ভেবে পাচ্ছি না। স্থানীয় মহর আলী বলেন, তিনি প্রতি শতাংশ ৩লাখ টাকা করে শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল হাসান তার কাছ থেকে ৩২শতাংশ জমি কিনেছেন। বর্তমানে এই প্লটটির দাম কোটি টাকার উপরে হবে। নিজের বিরুদ্ধে উঠা বিভিন্ন অভিযোগ অস্বীকার করে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, বিভিন্ন প্রাথমিক শিক্ষকরা নানাভাবে তার বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্ধ চান। কিন্তু আমরা ধারাবাহিকতা বজায়ের স্বার্থে তা দিতে না পারায় হয়তো অনেকে ক্ষিপ্ত হয়ে এমন অভিযোগ করছেন। এসবের কোন সত্যতা নেই। কর্মরত স্টেশনে জমি কেনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি ২০০৮ সালে এবং তারও বেশ কয়েকবছর পূর্বে এসব জমি কিনেছিলাম। যদিও এখন তা বিক্রি করে দিচ্ছি। জমি কেনার অর্থের বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোফাজ্জল হোসেন বলেন, তার কাছে এখনো এমন কোন অভিযোগ আসেনি। তবে খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান তিনি ।