ময়মনসিংহ ০২:১৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কেন ইয়াবা সেবন করে এর নেপথ্যে কি?

দৈনিক মুক্তকণ্ঠ
  • আপলোড সময়: ০২:৫৬:৩৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ এপ্রিল ২০২১
  • / ২৬৭৬ বার পড়া হয়েছে

মুক্তকণ্ঠ ডেস্কঃ ইয়াবা- মাদকটির মূল উপাদান “মেথ-অ্যামফিটামিন”। একসময় যা সর্দি ও নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ওষুধ হিসেবে ব্যবহূত হতো কোনো কোনো দেশে। ব্যবহার করা হতো ওজন কমানোর চিকিৎসায়ও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ক্লান্তি দূর করতে ও সজাগ থাকতে সেনাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল মেথঅ্যামফিটামিন। পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষ বিশেষত শিক্ষার্থী, দীর্ঘযাত্রার গাড়িচালক ও দৌড়বিদেরা এটি ব্যবহার শুরু করেন।

ইয়াবার আগমনঃ- সময়ের সসাথে ধীরে ধীরে এর কুফল বা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া উদঘাটিত হতে থাকায় বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। তবে বিশ্বের কয়েকটি দেশে এর উৎপাদন চলতেই থাকে। “মেথ-অ্যামফিটামিন” এর সঙ্গে ক্যাফেইন মিশিয়ে ব্যবহূত হতে থাকে মাদকদ্রব্য হিসেবে। থাইল্যান্ডে এই মাদকটির উৎপাদন হয় সবচেয়ে বেশি। ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশে। গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, পেথেডিনের পথ ধরে বাংলাদেশেও এখন সহজলভ্য হয়ে উঠেছে মাদকটি। অনেকে একে বলে ‘’ক্রেজি মেডিসিন’’ বা পাগলা ওষুধ। অনেকের কাছে তা “নাজি স্পিড” বা শুধু “স্পিড”। আবার অনেকেই আআদর ককরে ডাকে “বাবা”!

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের অনেক এলাকায় এর লেনদেন হয় ‘বাবা’ নামেই। হালের মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের কাছে এ মাদকটি সমধিক পরিচিত ‘‘ইয়াবা’’ অথবা “বাবা” নামেই।

ইয়াবা” মূলত একটি থাই শব্দঃ- নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও ধরা হয়, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে ইয়াবার আবির্ভাব ঘটে। পরবর্তী সময়ে ২০০০ সাল থেকে সীমান্তপথে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে চোরাচালান হয়ে তা দেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে। প্রথম দিকে উচ্চমূল্যের কারণে ইয়াবার প্রচলন সীমাবদ্ধ ছিল শুধু উচ্চবিত্ত ব্যক্তিদের মধ্যেই। পরে প্রচণ্ড উত্তেজক ও নেশাকারক এ ট্যাবলেটটির উপকরণ চোরাইপথে এনে দেশের ভেতরেই তা তৈরি করা শুরু হয়। দাম কিছুটা কমতে থাকে। ফলে উচ্চবিত্তের গণ্ডি ছাড়িয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত যুবক-যুবতীদের মধ্যেও ইয়াবার বিস্তার ঘটে।

ইয়াবার প্রতি আকর্ষণের কারণঃ- তরুণ-তরুণীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে মূল উপাদানের সঙ্গে মেশানো হয় আঙুর, কমলা বা ভ্যানিলার ফ্লেভার; সবুজ বা লাল-কমলা রং। ইয়াবা নামের ছোট্ট এ ট্যাবলেটটি দেখতে অনেকটা ক্যান্ডির মতো, স্বাদেও তেমনই। ফলে আসক্ত ব্যক্তিরা এর প্রচণ্ড ক্ষতিকর প্রভাবটুকু প্রথমে বুঝতে পারে না। একই কারণে এটি পরিবহন করা ও লুকিয়ে রাখাও সহজ।

অধিকাংশ মাদকসেবী ট্যাবলেটটি মুখেই গ্রহণ করে। অনেকে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের ওপর রাখা ট্যাবলেটের অপর প্রান্তে তাপ দিয়ে একে গলিয়ে ফেলে। এরপর সেখান থেকে যে বাষ্প বের হয়, তা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে। আবার ট্যাবলেটটি গুঁড়ো করে, পানিতে মিশিয়ে সিরিঞ্জের মাধ্যমে শিরাপথে সরাসরি রক্তেও ঢুকিয়ে দেয়। ইয়াবার আনন্দ আর উত্তেজনা আসক্ত ব্যক্তিদের সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দেয় জীবনের সব যন্ত্রণা। তারা বাস করে স্বপ্নের এক জগতে। ইয়াবার প্রচণ্ড উত্তেজক ক্ষমতা আছে বলে যৌন-উত্তেজক হিসেবে অনেকে ব্যবহার করে এটি। ক্ষুধা কমিয়ে দেয় বলে স্লিম হওয়ার ওষুধ হিসেবে অনেকে শুরু করে ইয়াবা সেবন। ঘুম কমিয়ে দেয়, সারা রাতের পার্টির আগে ক্লান্তিহীন উপভোগ নিশ্চিত করতে অনেকের পছন্দ ইয়াবা।কিন্তু এই সাময়িক আনন্দের ট্যাবলেটটি যে তাদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে, তা টের পাওয়ারও অবকাশ সে সময় তাদের থাকে না।

প্রথমে কম ডোজে এ ট্যাবলেট কাজ করলেও ধীরে ধীরে ডোজ বাড়াতে হয়। আগে যে পরিমাণ ইয়াবা আনন্দ এনে দিত, পরে তাতে আর হয় না। বাড়তে থাকে ট্যাবলেটের পরিমাণ, ক্ষণস্থায়ী আনন্দের পর বাড়তে থাকে ক্ষতিকর নানা উপসর্গও।

ইয়াবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ- রাত কাটে নির্ঘুম, ইয়াবা প্রতিক্রিয়ায় টানা সাত থেকে ১০ দিনও জেগে থাকতে বাধ্য হয় অনেকে। শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে, মেজাজ হয় খিটখিটে, গলা-মুখ শুকিয়ে আসতে থাকে অনবরত। প্রচণ্ড ঘাম আর গরমের অসহ্য অনুভূতি বাড়তে থাকে। বাড়ে নাড়ির গতি, রক্তচাপ, দেহের তাপমাত্রা আর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি।

দীর্ঘদিনের আসক্ত ব্যক্তিরা উচ্চরক্তচাপের রোগীই হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের ভেতরকার ছোট রক্তনালিগুলো ক্ষয় হতে থাকে, এগুলো ছিঁড়ে অনেকের রক্তক্ষরণ শুরু হয়। স্মৃতিশক্তি কমে যায়, মানসিক নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, অহেতুক রাগারাগি, ভাঙচুরের প্রবণতা বাড়ে। পড়াশোনা, কর্মক্ষেত্র বা পারিবারিক জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। সব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বা পিছিয়ে পড়তে থাকায় আসক্ত ব্যক্তিরা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়।

কারও কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। দৃষ্টিবিভ্রম, শ্রুতিবিভ্রম আর অস্বাভাবিক সন্দেহ প্রভৃতি উপসর্গ থেকে একসময় সিজোফ্রেনিয়ার মতো জটিল মানসিক ব্যাধিও দেখা দেয়। বেশি পরিমাণে নেওয়া ইয়াবা শারীরবৃত্তীয় স্বাভাবিক কার্যক্রমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। আর যারা সিরিঞ্জের মাধ্যমে দেহে ইয়াবা প্রবেশ করায়, তারা হেপাটাইটিস বি, সি ও এইডসের মতো মারাত্মক রক্তবাহিত রোগের জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে।

নেশা ছাড়তে চাইলেও ছাড়া যায় না কেন?
ইয়াবার পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি আসক্ত ব্যক্তিরা এর ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একবার ইয়াবা নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা বা নির্দিষ্ট সময় পর আবার না নিলে শরীরে ও মনে নানা উপসর্গ দেখা দেয়, ফলে বাধ্য হয়ে আসক্ত ব্যক্তিরা আবার ফিরে যায় নেশার জগতে।

বাংলাদেশে ইয়াবা বানিজ্য এবং সেবনের পোষ্টমার্টেমঃ- ইয়াবা তৈরীর মূল কাঁচামাল হল “সিউডোএফিড্রিন”। এক কেজির দাম মাত্র ৪ হাজার টাকা যা থেকে ১ লাখ পিস “ইয়াবা” ট্যাবলেট তৈরী করা যায়, যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা!

এই “সিউডোএফিড্রিন” এর সাথে “রেড ফসফরাস” দিয়ে বিক্রিয়া ঘটিয়ে মিথাইল অ্যামফিটামিন বানানো হয় যার ডাক নাম “ইয়াবা”!
মাত্র কয়েক হাজার টাকা বিনিয়োগ করে কয়েক কোটি টাকা লাভের এই ব্যবসা বাংলাদেশে রমরমা হয়ে উঠেছে।বছরে ১লক্ষ কোটি টাকা, ইয়াবার কারণে যে টাকা মিয়ানমারে পাচার হয়ে যাচ্ছে, যা দিয়ে অনায়াসে দুটি পদ্মাসেতু তৈরী করা যায়। দেশে প্রায় প্রতি ১০০ জনে ১৬ জন মানুষ ইয়াবা সেবন করে!!!

গত বছর কেবল মাদক উদ্ধার এবং পাচারের উপর এক লাখ মামলা হয়েছিলো! যার এক তৃতীয়াংশ ইয়াবা! ভাবা যায়!
ঢাকার একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে সুস্থ হয়ে ফেরার পর এক লোক বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘ইয়াবা এখন ফোন করলে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়!’ ‘বাবা পাঠাও’ এক্কেবারে হোম ডেলিভারি নামে নতুন কোন অ্যাপস আছে কি না জানি না, শুধু জানি যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে! পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ!

যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ট্যাবলেটটি খেয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে অনেকে হয়ে যাচ্ছে ধর্ষক! ধর্ষিত হচ্ছে মানবতা কিংবা বিবেক, গত দশ বছরের ধর্ষকদের ৮০ ভাগই ইয়াবাসেবী। ইয়াবার সেই টাকা জোগাড় করতে ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে খুন ডাকাতি ছিনতাই…….!

কিছুদিন আগে এক নারীর ভ্যানেটি ব্যাগ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিলো ৪৩ লাখ টাকার ইয়াবা! ভাবা যায় কত সহজে বাবা পাচার হয়! জাতি গড়ার কারখানা স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও ইয়াবা গ্রাস করে ফেলছে দিনকে দিন। আপনিও আপনার আশে পাশে খোঁজ করলে এমন কয়েকটি ঘটনা খুঁজে পাবেন, এখনি যদি এই সমস্যার মোকাবেলা করা না হয় তাহলে ইয়াবা সেবনের সংখ্যাটি ১৬ শতাংশ থেকে ৬১ শতাংশে রুপ নেবে!

মাদকের উত্তেজনায় আত্মহারা হয়ে মা বোনকে ধর্ষণ করছে। যেখানে পবিত্র কোরআন শরীফের ভিতরে করে পর্যন্ত ইয়াবা পাচার করা হয় সেখানে চোরদের ধর্মের কাহিনী শুনিয়ে লাভ হবে না, আলোচিত জন্মদিনের পার্টিতে ডেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ করা সাফাত আহমেদ স্বীকার করেছিলেন সে ঐ রাতে ইয়াবা খেয়ে আরো তিন তরুণীকে নিয়ে ফূর্তি করেছিলেন!

ছিনতাইকারী রাজীবের কথা মনে আছে? যে একটি মহিলার ব্যাগ হ্যাঁচকা টান দেওয়ার পর মহিলার কোল থেকে পড়ে শিশুর নির্মম মৃত্যু হয়েছিলো সেই রাজীব বলেছিলো ইয়াবার নেশা তাকে রাতে ঘুমাতে দিতো না তাই সে বেপোরোয়া হয়ে ছিনতাই করতো, ছিনতাইকারীর ছুড়ির আঘাতে নিহত ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র খন্দকার আবু তালহার খুনীরা স্বীকার করেছিলো তারা ইয়াবায় আসক্ত ছিলো।

রাজধানীর নাজিম নামে এক আসক্ত ইয়াবার টাকা জোগাড় করতে তার আপন বোনকে অপহরণ করে ১৭ ঘন্টা পর মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে মুক্তি দিয়েছিলো। কিছুদিন আগে একটি খবর পড়েছিলাম দেশে প্রতি দশটি ভয়ঙ্কর অপরাধের মধ্যে আটটি ইয়াবার আসক্তির কারণে হচ্ছে!!! ইয়াবা সেবন করে মুহুর্তের মধ্যে মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে ধর্ষণ করে গলা কেটে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে অহরহ!

চোখের সামনে দিয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে একটি দেশ যার জন্য ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং বীরঙ্গনা জীবন বাজী রেখেছিলো। আসুন মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলি। মাদক সেবনে সবাইক নিরুৎসাহী করি। সমাজ ও দেশকে রক্ষা করি।

ট্যাগস :

Please Share This Post in Your Social Media

About Author Information

কেন ইয়াবা সেবন করে এর নেপথ্যে কি?

আপলোড সময়: ০২:৫৬:৩৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ এপ্রিল ২০২১

মুক্তকণ্ঠ ডেস্কঃ ইয়াবা- মাদকটির মূল উপাদান “মেথ-অ্যামফিটামিন”। একসময় যা সর্দি ও নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ওষুধ হিসেবে ব্যবহূত হতো কোনো কোনো দেশে। ব্যবহার করা হতো ওজন কমানোর চিকিৎসায়ও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ক্লান্তি দূর করতে ও সজাগ থাকতে সেনাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল মেথঅ্যামফিটামিন। পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষ বিশেষত শিক্ষার্থী, দীর্ঘযাত্রার গাড়িচালক ও দৌড়বিদেরা এটি ব্যবহার শুরু করেন।

ইয়াবার আগমনঃ- সময়ের সসাথে ধীরে ধীরে এর কুফল বা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া উদঘাটিত হতে থাকায় বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। তবে বিশ্বের কয়েকটি দেশে এর উৎপাদন চলতেই থাকে। “মেথ-অ্যামফিটামিন” এর সঙ্গে ক্যাফেইন মিশিয়ে ব্যবহূত হতে থাকে মাদকদ্রব্য হিসেবে। থাইল্যান্ডে এই মাদকটির উৎপাদন হয় সবচেয়ে বেশি। ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশে। গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, পেথেডিনের পথ ধরে বাংলাদেশেও এখন সহজলভ্য হয়ে উঠেছে মাদকটি। অনেকে একে বলে ‘’ক্রেজি মেডিসিন’’ বা পাগলা ওষুধ। অনেকের কাছে তা “নাজি স্পিড” বা শুধু “স্পিড”। আবার অনেকেই আআদর ককরে ডাকে “বাবা”!

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের অনেক এলাকায় এর লেনদেন হয় ‘বাবা’ নামেই। হালের মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের কাছে এ মাদকটি সমধিক পরিচিত ‘‘ইয়াবা’’ অথবা “বাবা” নামেই।

ইয়াবা” মূলত একটি থাই শব্দঃ- নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও ধরা হয়, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে ইয়াবার আবির্ভাব ঘটে। পরবর্তী সময়ে ২০০০ সাল থেকে সীমান্তপথে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে চোরাচালান হয়ে তা দেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে। প্রথম দিকে উচ্চমূল্যের কারণে ইয়াবার প্রচলন সীমাবদ্ধ ছিল শুধু উচ্চবিত্ত ব্যক্তিদের মধ্যেই। পরে প্রচণ্ড উত্তেজক ও নেশাকারক এ ট্যাবলেটটির উপকরণ চোরাইপথে এনে দেশের ভেতরেই তা তৈরি করা শুরু হয়। দাম কিছুটা কমতে থাকে। ফলে উচ্চবিত্তের গণ্ডি ছাড়িয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত যুবক-যুবতীদের মধ্যেও ইয়াবার বিস্তার ঘটে।

ইয়াবার প্রতি আকর্ষণের কারণঃ- তরুণ-তরুণীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে মূল উপাদানের সঙ্গে মেশানো হয় আঙুর, কমলা বা ভ্যানিলার ফ্লেভার; সবুজ বা লাল-কমলা রং। ইয়াবা নামের ছোট্ট এ ট্যাবলেটটি দেখতে অনেকটা ক্যান্ডির মতো, স্বাদেও তেমনই। ফলে আসক্ত ব্যক্তিরা এর প্রচণ্ড ক্ষতিকর প্রভাবটুকু প্রথমে বুঝতে পারে না। একই কারণে এটি পরিবহন করা ও লুকিয়ে রাখাও সহজ।

অধিকাংশ মাদকসেবী ট্যাবলেটটি মুখেই গ্রহণ করে। অনেকে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের ওপর রাখা ট্যাবলেটের অপর প্রান্তে তাপ দিয়ে একে গলিয়ে ফেলে। এরপর সেখান থেকে যে বাষ্প বের হয়, তা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে। আবার ট্যাবলেটটি গুঁড়ো করে, পানিতে মিশিয়ে সিরিঞ্জের মাধ্যমে শিরাপথে সরাসরি রক্তেও ঢুকিয়ে দেয়। ইয়াবার আনন্দ আর উত্তেজনা আসক্ত ব্যক্তিদের সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দেয় জীবনের সব যন্ত্রণা। তারা বাস করে স্বপ্নের এক জগতে। ইয়াবার প্রচণ্ড উত্তেজক ক্ষমতা আছে বলে যৌন-উত্তেজক হিসেবে অনেকে ব্যবহার করে এটি। ক্ষুধা কমিয়ে দেয় বলে স্লিম হওয়ার ওষুধ হিসেবে অনেকে শুরু করে ইয়াবা সেবন। ঘুম কমিয়ে দেয়, সারা রাতের পার্টির আগে ক্লান্তিহীন উপভোগ নিশ্চিত করতে অনেকের পছন্দ ইয়াবা।কিন্তু এই সাময়িক আনন্দের ট্যাবলেটটি যে তাদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে, তা টের পাওয়ারও অবকাশ সে সময় তাদের থাকে না।

প্রথমে কম ডোজে এ ট্যাবলেট কাজ করলেও ধীরে ধীরে ডোজ বাড়াতে হয়। আগে যে পরিমাণ ইয়াবা আনন্দ এনে দিত, পরে তাতে আর হয় না। বাড়তে থাকে ট্যাবলেটের পরিমাণ, ক্ষণস্থায়ী আনন্দের পর বাড়তে থাকে ক্ষতিকর নানা উপসর্গও।

ইয়াবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ- রাত কাটে নির্ঘুম, ইয়াবা প্রতিক্রিয়ায় টানা সাত থেকে ১০ দিনও জেগে থাকতে বাধ্য হয় অনেকে। শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে, মেজাজ হয় খিটখিটে, গলা-মুখ শুকিয়ে আসতে থাকে অনবরত। প্রচণ্ড ঘাম আর গরমের অসহ্য অনুভূতি বাড়তে থাকে। বাড়ে নাড়ির গতি, রক্তচাপ, দেহের তাপমাত্রা আর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি।

দীর্ঘদিনের আসক্ত ব্যক্তিরা উচ্চরক্তচাপের রোগীই হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের ভেতরকার ছোট রক্তনালিগুলো ক্ষয় হতে থাকে, এগুলো ছিঁড়ে অনেকের রক্তক্ষরণ শুরু হয়। স্মৃতিশক্তি কমে যায়, মানসিক নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, অহেতুক রাগারাগি, ভাঙচুরের প্রবণতা বাড়ে। পড়াশোনা, কর্মক্ষেত্র বা পারিবারিক জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। সব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বা পিছিয়ে পড়তে থাকায় আসক্ত ব্যক্তিরা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়।

কারও কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। দৃষ্টিবিভ্রম, শ্রুতিবিভ্রম আর অস্বাভাবিক সন্দেহ প্রভৃতি উপসর্গ থেকে একসময় সিজোফ্রেনিয়ার মতো জটিল মানসিক ব্যাধিও দেখা দেয়। বেশি পরিমাণে নেওয়া ইয়াবা শারীরবৃত্তীয় স্বাভাবিক কার্যক্রমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। আর যারা সিরিঞ্জের মাধ্যমে দেহে ইয়াবা প্রবেশ করায়, তারা হেপাটাইটিস বি, সি ও এইডসের মতো মারাত্মক রক্তবাহিত রোগের জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে।

নেশা ছাড়তে চাইলেও ছাড়া যায় না কেন?
ইয়াবার পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি আসক্ত ব্যক্তিরা এর ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একবার ইয়াবা নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা বা নির্দিষ্ট সময় পর আবার না নিলে শরীরে ও মনে নানা উপসর্গ দেখা দেয়, ফলে বাধ্য হয়ে আসক্ত ব্যক্তিরা আবার ফিরে যায় নেশার জগতে।

বাংলাদেশে ইয়াবা বানিজ্য এবং সেবনের পোষ্টমার্টেমঃ- ইয়াবা তৈরীর মূল কাঁচামাল হল “সিউডোএফিড্রিন”। এক কেজির দাম মাত্র ৪ হাজার টাকা যা থেকে ১ লাখ পিস “ইয়াবা” ট্যাবলেট তৈরী করা যায়, যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা!

এই “সিউডোএফিড্রিন” এর সাথে “রেড ফসফরাস” দিয়ে বিক্রিয়া ঘটিয়ে মিথাইল অ্যামফিটামিন বানানো হয় যার ডাক নাম “ইয়াবা”!
মাত্র কয়েক হাজার টাকা বিনিয়োগ করে কয়েক কোটি টাকা লাভের এই ব্যবসা বাংলাদেশে রমরমা হয়ে উঠেছে।বছরে ১লক্ষ কোটি টাকা, ইয়াবার কারণে যে টাকা মিয়ানমারে পাচার হয়ে যাচ্ছে, যা দিয়ে অনায়াসে দুটি পদ্মাসেতু তৈরী করা যায়। দেশে প্রায় প্রতি ১০০ জনে ১৬ জন মানুষ ইয়াবা সেবন করে!!!

গত বছর কেবল মাদক উদ্ধার এবং পাচারের উপর এক লাখ মামলা হয়েছিলো! যার এক তৃতীয়াংশ ইয়াবা! ভাবা যায়!
ঢাকার একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে সুস্থ হয়ে ফেরার পর এক লোক বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘ইয়াবা এখন ফোন করলে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়!’ ‘বাবা পাঠাও’ এক্কেবারে হোম ডেলিভারি নামে নতুন কোন অ্যাপস আছে কি না জানি না, শুধু জানি যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে! পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ!

যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ট্যাবলেটটি খেয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে অনেকে হয়ে যাচ্ছে ধর্ষক! ধর্ষিত হচ্ছে মানবতা কিংবা বিবেক, গত দশ বছরের ধর্ষকদের ৮০ ভাগই ইয়াবাসেবী। ইয়াবার সেই টাকা জোগাড় করতে ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে খুন ডাকাতি ছিনতাই…….!

কিছুদিন আগে এক নারীর ভ্যানেটি ব্যাগ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিলো ৪৩ লাখ টাকার ইয়াবা! ভাবা যায় কত সহজে বাবা পাচার হয়! জাতি গড়ার কারখানা স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও ইয়াবা গ্রাস করে ফেলছে দিনকে দিন। আপনিও আপনার আশে পাশে খোঁজ করলে এমন কয়েকটি ঘটনা খুঁজে পাবেন, এখনি যদি এই সমস্যার মোকাবেলা করা না হয় তাহলে ইয়াবা সেবনের সংখ্যাটি ১৬ শতাংশ থেকে ৬১ শতাংশে রুপ নেবে!

মাদকের উত্তেজনায় আত্মহারা হয়ে মা বোনকে ধর্ষণ করছে। যেখানে পবিত্র কোরআন শরীফের ভিতরে করে পর্যন্ত ইয়াবা পাচার করা হয় সেখানে চোরদের ধর্মের কাহিনী শুনিয়ে লাভ হবে না, আলোচিত জন্মদিনের পার্টিতে ডেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ করা সাফাত আহমেদ স্বীকার করেছিলেন সে ঐ রাতে ইয়াবা খেয়ে আরো তিন তরুণীকে নিয়ে ফূর্তি করেছিলেন!

ছিনতাইকারী রাজীবের কথা মনে আছে? যে একটি মহিলার ব্যাগ হ্যাঁচকা টান দেওয়ার পর মহিলার কোল থেকে পড়ে শিশুর নির্মম মৃত্যু হয়েছিলো সেই রাজীব বলেছিলো ইয়াবার নেশা তাকে রাতে ঘুমাতে দিতো না তাই সে বেপোরোয়া হয়ে ছিনতাই করতো, ছিনতাইকারীর ছুড়ির আঘাতে নিহত ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র খন্দকার আবু তালহার খুনীরা স্বীকার করেছিলো তারা ইয়াবায় আসক্ত ছিলো।

রাজধানীর নাজিম নামে এক আসক্ত ইয়াবার টাকা জোগাড় করতে তার আপন বোনকে অপহরণ করে ১৭ ঘন্টা পর মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে মুক্তি দিয়েছিলো। কিছুদিন আগে একটি খবর পড়েছিলাম দেশে প্রতি দশটি ভয়ঙ্কর অপরাধের মধ্যে আটটি ইয়াবার আসক্তির কারণে হচ্ছে!!! ইয়াবা সেবন করে মুহুর্তের মধ্যে মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে ধর্ষণ করে গলা কেটে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে অহরহ!

চোখের সামনে দিয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে একটি দেশ যার জন্য ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং বীরঙ্গনা জীবন বাজী রেখেছিলো। আসুন মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলি। মাদক সেবনে সবাইক নিরুৎসাহী করি। সমাজ ও দেশকে রক্ষা করি।